শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৫ অপরাহ্ন
ক্রাইমসিন২৪ ডেস্ক: দালালচক্রের বিভিন্ন প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৩-২০১৪ সালে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সাগরে ডুবে মারা যায়। সেই যাত্রায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক হাজার যুবক।
কিন্তু প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও অভিযানের কারণে সে সময় মানবপাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। এবার তাদের টার্গেট প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।
উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির থেকে কৌশলে পালিয়ে দালালের হাত ধরে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্ঠা করছেন। এভাবে সর্বশেষ গত শনিবার (১৮ মে) রাতে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্ঠার সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন ৮৭ জন রোহিঙ্গা। আর সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রার সময় গত ৬ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে উদ্ধার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু।
জানা গেছে, গত বছরের ৬ নভেম্বর প্রথমবারের মতো ফের মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওইদিন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের উপকূল থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্ঠার সময় ১৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বিজিবি। দালাল চক্র মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে দু’দিন ধরে সাগরে এদিক-ওদিক ঘোরানোর পর ‘থাইল্যান্ডের তীরে পৌঁছেছি’ বলে টেকনাফের সৈকতে তাদের নামিয়ে দেয়। পরে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে।
পরদিন ৭ নভেম্বর একইভাবে আরো ৩৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার
করে কোস্টগার্ড। এসময় ছয় দালালকেও আটক করা হয়। তারা আবার স্থানীয়।
আইন-শৃখলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার
চেষ্ঠার সময় গত ৬ নভেম্বর থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ২০ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন
এলাকা থেকে ৪৮১ জন রোহিঙ্গা ও ২ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর সদস্যরা। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পুরিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা হওয়ায় কক্সবাজারে মানবপাচারের ঘটনা বেশি। এছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে সম্প্রতি আবারও মানবপাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকায় ধরাও পড়ছে।
তিনি বলেন, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মানবপাচারের ঘটনায় ৪৩৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়াও প্রতি মাসেই মানবপাচারের মামলা হচ্ছে। বিভিন্ন ভিত্তিতে কক্সবাজার জেলা পুলিশ মানবপাচারকারীদের একটি তালিকাও তৈরি করেছে। বর্তমানে নতুন করে আরো একটি তালিকার কাজ চলমান রয়েছে। পুরনো এবং নতুন তালিকা ধরে অভিযান আবার জোরদার করা হবে।
জানা গেছে, প্রথমদিকে টেকনাফ-মিয়ানমার আন্তঃসীমান্তে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় থাকলেও পরে কক্সবাজার জেলা পেরিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকার শহরতলী হয়ে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত নেটওয়ার্ক বিস্তার করে। এই নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব দেয় মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে এসে বসতি গড়া রোহিঙ্গারা। পরে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি এই নেটওয়ার্কটি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা অপহরণের পর বিদেশে পাচার করে মুক্তিপণ আদায়, থাইল্যান্ডে দাস শ্রমিক হিসেবে বিক্রি, এমনকি খুনও করে থাকে। এই চক্রের খপ্পরে পড়ে শত শত যুবক নিখোঁজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রামে চলছে এখনও কান্নার রোল।
জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্নে দালালের মাধ্যমে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে থাইল্যান্ডে দাসখানায় মারা যায় কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়ার শুক্কুর আহমদ ড্রাইভারের ২৩ বছর বয়সী ছেলে পুতিয়া। তারই মতো মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে একই ইউনিয়নের সেগুনবাগিচা এলাকার শাহ আলমের মেয়ে জামাই আবুল হাশেমসহ খুটাখালী গ্রামের মাত্র একটি ওয়ার্ডের (৬ নং ওয়ার্ড) ১৪ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। খোঁজ মেলেনি হাশেম ড্রাইভারের ছেলে হামিদুল হকের, ইসলাম নুরের ছেলে রবিউল হাসানের, সুলতানের ছেলে জিয়াউর রহমানের, মোহাম্মদ ইসলামের ছেলে মনুর আলমের, বদরার ছেলে আনোয়ারের, লোকমান হাকিমের ছেলে মিজানের, অহিদুল আলম ধেছুর ছেলে ইউনুছের, সোলেমানের ছেলে কালুর, ইউসুফ আলী ছেলে আনোয়ারের, সুলতানের ছেলে নুর মোস্তফার, অলি আহমদের ছেলে কাদুরার, বাদশা মিয়ার ছেলে ফারুকের এবং আয়ূব আলীর ছেলে জসিমউদ্দিনের। এদেরই মতো কক্সবাজারের রামুর রাজারকুল, দারিয়ার দিঘী, খুনিয়াপালংসহ বিভিন্ন গ্রামের শত শত মালয়েশিয়াগামী যুবকের কোনো খোঁজ নেই দীর্ঘদিনেও। এসব ঘটনায় আসলে কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও সরকারি-বেসরকারি কোনো দপ্তরে নেই।
ওই সময় মালয়েশিয়াগামী অনেক মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে মারা যায়। অনেকেই সমুদ্রে দালালচক্রের গুলিতে মারা যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত রোহিঙ্গা দালালেরাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের এ রুটটি আবিষ্কার করে। অসচ্ছল ও বেকার যুবকদের জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নগদ ১০ থেকে ২০ হাজার ও দেড়-দুই লাখ টাকা বাকিতে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার শর্তে সহজেই ফাঁদে ফেলছে; বিশেষ করে যুবকদের। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ছোট নৌকাযোগে উপকূল থেকে সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। সেই জাহাজ ১০ দিন পর থাইল্যান্ড পৌঁছে দেয়। থাইল্যান্ডে অবস্থানের সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ পেলে মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বিভিন্ন খামারে শ্রমিক হিসাবে পাঠানো হয়। কারো মুক্তিপণ পাওয়া না গেলে তাদেরকে থাইল্যান্ডে দাস শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। অথবা দিনের পর দির সেখানে নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি নির্যাতনে মারাও গেছেন অনেকেই। কিন্তু স্থানীয়রা আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে না পারলেও এখন রোহিঙ্গারা সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছে মানবপাচারকারীদের। মিয়ানমারে জোর করে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, সেখানে গেলে মগেরা কেটে ফেলবে, বিশেষ করে নারীরা মালয়েশিয়া গেলে ভালো বরের সঙ্গে বিয়ে হবে, যুবকদের ভালো চাকরি হবে এমন বিভিন্ন ভয় ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে মানবপাচারকারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এক মাঝি (নেতা) জানান, যাদের আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়ায় বসবাস করছে, এ ধরনের রোহিঙ্গারাই মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। তারা হুন্ডির মাধ্যমে দালালদের কাছে টাকা পাঠায়। আবার যাদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে নেই তারাও উন্নত জীবনের আশায়, অবিবাহিত নারীরা বিয়ের প্রলোভনে মালয়েশিয়া চলে যেতে চায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া ত্রাণ সামগ্রী বিক্রি করে টাকা জমিয়ে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, সড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক চেকপোস্ট থাকলেও দালালের হাত ধরে রাতের আঁধারে পাহাড়ি পথে রোহিঙ্গারা বাইরে পাচারের শিকার হচ্ছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আসা ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকগুলো চেকপোস্ট থাকলেও ক্যাম্পগুলো পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে ক্যাম্প এলাকাটি কাঁটাতারের বেড়া বা সীমানা প্রাচীর দেওয়ার প্রস্তাবের কথা ভাবছে পুলিশ।
ক্যাম্প এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল আরো জোরদারের বিষয়টি নিয়েও ভাবছে পুলিশ।